হাতে বা কব্জিতে ব্যথা কেন হয়? - ডা: দেবজ্যোতি দত্ত
- Dr Debjyoti Dutta
- Apr 10
- 17 min read
সমব্যথী পেইন ক্লিনিক

হাতে বা কব্জিতে ব্যথা কেন হয়? - আমাদের হাত ও কব্জি শুধু একটি অঙ্গ নয়, বরং আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ছোট-বড় কাজের নির্ভরযোগ্য অংশীদার। সকালে ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করা থেকে শুরু করে রান্না করা, কম্পিউটারে কাজ, লেখালেখি, খেলাধুলা কিংবা সৃজনশীল কোনো কাজ—সবকিছুতেই হাতের প্রয়োজন। কিন্তু এই হাত বা কব্জিতে যখন ব্যথা শুরু হয়, তখন তা কেবল একটি শারীরিক সমস্যা নয়; বরং জীবনযাত্রার মানকে উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
আজকের আলোচনায় আমরা বিস্তারিতভাবে জানব হাতে বা কব্জিতে ব্যথা কেন হয়, এর পিছনে সম্ভাব্য কারণগুলো কী কী, লক্ষণ কীভাবে বুঝবেন এবং এর সঠিক চিকিৎসা ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা কী হতে পারে।
হাতে বা কব্জিতে ব্যথা কেন হয়?
হাতে বা কব্জিতে ব্যথা বিভিন্ন কারণে হতে পারে। এর মধ্যে কিছু সাধারণ কারণ নিম্নরূপ:
১. আঘাতজনিত কারণ (Trauma)

আমাদের হাতে বা কব্জিতে ব্যথার সবচেয়ে সাধারণ ও পরিচিত কারণ হলো আঘাতজনিত সমস্যা। দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে, কাজ করার সময়, খেলাধুলার ময়দানে কিংবা যেকোনো দুর্ঘটনার কারণে হঠাৎ করে আমাদের হাতে বা কব্জিতে আঘাত লাগতে পারে। এই ধরনের আঘাতে আমাদের হাতের ভেতরের বিভিন্ন নরম কাঠামো, যেমন—লিগামেন্ট (Ligament), টেন্ডন (Tendon), মাংসপেশী (Muscle) ইত্যাদিতে টান পড়তে পারে বা এগুলো ছিঁড়ে যেতে পারে। অনেক সময় এই আঘাতের কারণে হাড়ে চিড় ধরতে পারে বা হাড় পুরোপুরি ভেঙেও যেতে পারে। কখনো কখনো জয়েন্টের অবস্থান সরে গিয়ে একটি গুরুতর অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে।
বিশেষত ক্রীড়াবিদ, শিশুরা, বয়স্ক ব্যক্তিরা এবং যারা দৈনন্দিন কঠোর পরিশ্রম বা শারীরিক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেন, তাদের মধ্যে এ ধরনের আঘাতের ঝুঁকি অনেক বেশি।
আঘাতজনিত ব্যথার লক্ষণগুলো কী কী?
হাতে বা কব্জিতে কোনো আঘাত লাগলে কিছু নির্দিষ্ট লক্ষণ প্রকাশ পায়, যেগুলো দিয়ে সমস্যাটির গুরুত্ব নির্ণয় করা সম্ভব। উল্লেখযোগ্য লক্ষণগুলো হলো:-
তীব্র ব্যথা:আঘাত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আহত স্থানে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হয়, যা সাধারণত হাত বা কব্জির নড়াচড়ায় বৃদ্ধি পায়। ব্যথা এতটাই তীব্র হতে পারে যে, হাতের স্বাভাবিক কাজ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
ফোলা ও লালচে হওয়া:আঘাতের স্থানে দ্রুত ফোলা শুরু হয়। এটি মূলত সেই স্থানে রক্তসঞ্চালন বেড়ে যাওয়া ও স্থানীয় প্রদাহের কারণে হয়ে থাকে। গুরুতর আঘাতে জায়গাটি বেশ লালচে বা নীলচে বর্ণ ধারণ করতে পারে।
হাতের নড়াচড়ায় সমস্যা:কব্জি বা হাতের আঘাতের ফলে জয়েন্ট ও পেশিতে ব্যথার কারণে স্বাভাবিক নড়াচড়া সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। অনেক সময় ব্যথার কারণে আক্রান্ত অংশটি একেবারেই নাড়ানো যায় না।
হাড়ের বিকৃতি:গুরুতর ক্ষেত্রে হাড় ভেঙে যাওয়া বা জয়েন্ট সরে গেলে হাতের আকৃতি অস্বাভাবিক হয়ে যেতে পারে। কখনো কখনো হাড়ের ফাটল বা স্থানচ্যুতি বাহ্যিকভাবে দেখা যায় বা স্পর্শে অনুভূত হয়।
আঘাতজনিত ব্যথায় প্রাথমিক চিকিৎসা কীভাবে করবেন?
কব্জি বা হাতে হঠাৎ কোনো আঘাত লাগলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রাথমিক চিকিৎসা করা উচিত। এটি ব্যথা কমাতে, ফোলা নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং বড় ধরনের জটিলতা এড়াতে সহায়তা করে। প্রাথমিক চিকিৎসার গুরুত্বপূর্ণ ধাপগুলো হলো:
বরফ প্রয়োগ (Ice therapy):আঘাতের পরপরই প্রথম করণীয় হলো ব্যথার স্থানে বরফ প্রয়োগ করা। এটি প্রদাহ ও ফোলা দ্রুত কমিয়ে দেয়। বরফ সরাসরি ত্বকে লাগাবেন না, একটি কাপড়ে বা বরফের থলেতে নিয়ে ১৫ থেকে ২০ মিনিট ধরে চাপ দিয়ে রাখুন। প্রথম ২৪ ঘণ্টায় প্রতি ২-৩ ঘণ্টা পরপর এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে ভালো ফল পাবেন।
পূর্ণ বিশ্রাম (Rest):আহত স্থানটিকে সম্পূর্ণ বিশ্রাম দেওয়া জরুরি। হাত বা কব্জিকে যতটা সম্ভব কম নাড়াচাড়া করুন। বিশ্রামের মাধ্যমে টিস্যুর দ্রুত নিরাময় ঘটে এবং বাড়তি ক্ষতি হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
সংকোচন (Compression):হাত বা কব্জিকে একটি ক্রেপ ব্যান্ডেজ দিয়ে হালকাভাবে বাঁধুন। এটি ফোলা নিয়ন্ত্রণ করবে এবং ব্যথা কমাবে। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন খুব টাইট করে না বাঁধা হয়, কারণ তাতে রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
উঁচু স্থানে রাখা (Elevation):আক্রান্ত হাতকে কিছুটা উঁচুতে রাখতে হবে। হাতের অবস্থান হৃদপিণ্ডের চেয়ে উঁচুতে থাকলে প্রদাহজনিত ফোলা ও ব্যথা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আসে। আপনি ঘুমানোর সময় হাতের নিচে একটি বালিশ বা উঁচু কিছু দিয়ে হাতকে সমর্থন দিয়ে রাখতে পারেন।
কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন?
আঘাত পাওয়ার পর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঘরে বসে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয় এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়ে। নিম্নলিখিত লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন:
ব্যথা বা ফোলা ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কমছে না, বরং বৃদ্ধি পাচ্ছে
হাতের কোনো অংশ অস্বাভাবিকভাবে বিকৃত হয়ে গেলে বা হাড় সরে গেলে
আঙুল বা কব্জিতে তীব্র অবশতা বা অসাড়তা অনুভব করলে
আক্রান্ত অংশে স্পর্শ করলে প্রচণ্ড ব্যথা হয় এবং নাড়ানো যায় না
আঘাতের পর প্রচুর রক্তক্ষরণ হলে বা চামড়া ছিঁড়ে গেলে
এই পরিস্থিতিতে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী এক্স-রে, এমআরআই, বা প্রয়োজনীয় অন্যান্য পরীক্ষা করিয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করা জরুরি। অনেক ক্ষেত্রে যথাযথ চিকিৎসা ছাড়া আঘাত থেকে দীর্ঘমেয়াদে জটিলতা দেখা দিতে পারে।
প্রতিরোধের উপায় কী?
খেলাধুলা বা ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সময় উপযুক্ত প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জাম (গ্লাভস, কব্জি গার্ড, হেলমেট ইত্যাদি) ব্যবহার করুন।
নিয়মিত শরীরচর্চা ও স্ট্রেচিং করুন, যা হাতের নমনীয়তা বৃদ্ধি করবে।
ভারী বস্তু ওঠানো বা বহনের সময় সতর্ক থাকুন।
ঘরের মেঝেতে পিচ্ছিল ভাব এড়ানোর ব্যবস্থা করুন।
হাতে বা কব্জিতে আঘাত পেলে দ্রুত সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলেই গুরুতর সমস্যা এড়ানো যায়। যত দ্রুত আঘাতের চিকিৎসা করা হবে, ততই হাতের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা দ্রুত ফিরে আসবে।
মনে রাখবেন, আপনার সচেতনতা ও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা হাত বা কব্জির দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির ঝুঁকি কমিয়ে দিতে পারে।
২। কারপাল টানেল সিন্ড্রোম (Carpal Tunnel Syndrome)

কারপাল টানেল সিন্ড্রোম হলো একধরনের স্নায়ুজনিত সমস্যা, যা মূলত কব্জির একটি সংকীর্ণ টানেলসদৃশ স্থানে মিডিয়ান নার্ভের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ার ফলে ঘটে। এই মিডিয়ান নার্ভটি কব্জি দিয়ে হাতের তালু ও কিছু আঙুলে স্নায়ুবোধ সরবরাহ করে। কারপাল টানেলটি একটি হাড় ও লিগামেন্ট দ্বারা তৈরি সরু চ্যানেল, যার মধ্যে দিয়ে মিডিয়ান নার্ভ ও ফ্লেক্সর টেন্ডনগুলো প্রবাহিত হয়। যখন এই চ্যানেল সংকুচিত হয় বা এর ভেতরের চাপ বেড়ে যায়, তখনই মিডিয়ান নার্ভ চাপে পড়ে এবং শুরু হয় কারপাল টানেল সিন্ড্রোমের লক্ষণ।
কারপাল টানেল সিন্ড্রোম কেন হয়?
দীর্ঘ সময় ধরে একটানা কম্পিউটার বা ল্যাপটপে কাজ করা
মাউস ব্যবহারে কব্জির ওপর চাপ পড়া
সূচিকর্ম, সেলাই, বুনন, ছবি আঁকা বা অন্যান্য সূক্ষ্ম হাতে কাজ
ড্রিল মেশিন বা কম্পনযুক্ত যন্ত্রপাতি ব্যবহারের পেশা
রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস, থাইরয়েড সমস্যা, ডায়াবেটিস
গর্ভাবস্থায় হরমোনজনিত পরিবর্তনের ফলে কব্জির তরল জমে যাওয়া
অতিরিক্ত ওজন বা ফ্লুইড রিটেনশন
লক্ষণসমূহ
কারপাল টানেল সিন্ড্রোমের উপসর্গগুলো ধীরে ধীরে শুরু হয় এবং সময়ের সাথে সাথে তীব্র হতে থাকে।
ঝিনঝিনে ভাব বা অবশতা:সাধারণত হাতের তালু, বুড়ো আঙুল, তর্জনী ও মধ্যমা আঙুলে অসাড়তা ও ঝিনঝিনে অনুভূতি হয়। এটি কখনো কখনো বাহুর দিকেও ছড়িয়ে যেতে পারে।
রাতে ব্যথা বৃদ্ধি:রাতের বেলায় ব্যথা বেশি হয় এবং অনেক সময় ঘুম ভেঙে যায়। অনেক রোগী বলেন, “ঘুম থেকে উঠে হাত ঝাঁকাতে হয়।”
দৈনন্দিন কাজে অসুবিধা:বোতাম লাগানো, কলম ধরা, মোবাইল চালানো বা চা-ডালের কাপ ধরা—এসব কাজে হাত কাঁপে, জিনিস হাত থেকে পড়ে যায়।
দীর্ঘস্থায়ী অবস্থায় পেশি ক্ষয়:সমস্যার চিকিৎসা না করলে বুড়ো আঙুলের পাশে থাকা থেনার মাসলে দুর্বলতা ও পেশি ক্ষয় হতে পারে।
কারপাল টানেল সিন্ড্রোমের চিকিৎসা
১. নন-সার্জিকাল চিকিৎসা (প্রাথমিক ও মাঝারি স্তরের রোগীদের জন্য)
রাতে কব্জিতে স্প্লিন্ট পরা:কারপাল টানেল সিন্ড্রোমের প্রাথমিক পর্যায়ে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো কব্জি স্থির রাখার জন্য স্প্লিন্ট ব্যবহার করা। এটি মূলত রাতে ব্যবহৃত হয় যাতে ঘুমের সময় কব্জি বাঁকানো না হয় এবং নার্ভে চাপ না পড়ে।
বিশেষ ব্যায়াম (Nerve gliding exercises):এই ব্যায়ামগুলোর মাধ্যমে মিডিয়ান নার্ভকে ধীরে ধীরে মুভমেন্টের অভ্যস্ত করানো হয়। এতে চাপ কমে এবং স্নায়ুর কার্যক্ষমতা ফিরে আসে।
ফিজিওথেরাপি:হাতের সুনির্দিষ্ট পেশির ব্যায়াম ও স্ট্রেচিং করে ব্যথা কমানো এবং কার্যক্ষমতা ফিরিয়ে আনা হয়। টেনিস বল চেপে ধরা, কব্জি ঘোরানো, আঙুল ছড়িয়ে ধরা—এসব সাধারণ ব্যায়াম অত্যন্ত উপকারী।
লাইফস্টাইল পরিবর্তন:কর্মক্ষেত্রে সঠিক ভঙ্গিমায় বসা, হাতের পজিশন ঠিক রাখা এবং বারবার বিরতি নেওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ।
২. আল্ট্রাসাউন্ড গাইডেড হাইড্রোডিসেকশন (Ultrasound-guided Hydrodissection)
এটি একটি আধুনিক, কার্যকর এবং কম ঝুঁকিপূর্ণ নন-সার্জিকাল পদ্ধতি।
প্রক্রিয়া কীভাবে হয়:
আল্ট্রাসাউন্ড মেশিনের সাহায্যে মিডিয়ান নার্ভকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা হয়।
এরপর অত্যন্ত সূক্ষ্ম সূঁচ ব্যবহার করে নার্ভ ও চারপাশের চ্যাপা টিস্যুর মধ্যে একটি তরল (যেমন স্যালাইন, লিডোকেইন বা স্টেরয়েড) ইনজেক্ট করা হয়।
এর ফলে নার্ভের উপর থেকে চাপে থাকা টিস্যুগুলো আলাদা হয়ে যায় এবং নার্ভ মুক্তভাবে কাজ করতে পারে।
হাইড্রোডিসেকশন কেন উপকারী:
অপারেশনের প্রয়োজন পড়ে না
একই দিনে করা যায় এবং দ্রুত বাড়ি ফেরা যায়
স্নায়ুতে রক্তসঞ্চালন বাড়ায় ও প্রদাহ কমায়
পুনরাবৃত্ত সমস্যায়ও কার্যকর
৩. সার্জিকাল চিকিৎসা (Carpal Tunnel Release Surgery)
যখন সব নন-সার্জিকাল চিকিৎসায় উপসর্গ ভালো না হয়, তখন শেষ ধাপে অপারেশন করা হয়।
অপারেশন কীভাবে হয়:
ছোট একটি কাট দিয়ে কারপাল লিগামেন্ট কেটে দেওয়া হয়, যাতে মিডিয়ান নার্ভের উপর থেকে চাপ কমে যায়।
এটি সাধারণত স্থানীয় অ্যানেস্থেশিয়ায় করা হয় এবং রুগী সেদিনই বাড়ি ফিরতে পারেন।
সফলতার হার:
বেশিরভাগ রোগীর ক্ষেত্রে ব্যথা অনেকটাই কমে যায় এবং হাতের কার্যক্ষমতা ফিরে আসে
অপারেশনের পরে কিছুদিন স্প্লিন্ট ব্যবহার ও হালকা ফিজিওথেরাপি প্রয়োজন হতে পারে
৩। অস্টিওআর্থ্রাইটিস (Osteoarthritis)

অস্টিওআর্থ্রাইটিস একটি বয়সজনিত ও ধীরে ধীরে গঠিত হওয়া দীর্ঘমেয়াদী জয়েন্ট রোগ, যা মূলত হাড়ের জয়েন্টের উপরিভাগে থাকা কার্টিলেজ ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়ে যাওয়ার ফলে হয়। এই কার্টিলেজ আসলে এক ধরনের স্নিগ্ধ ও মসৃণ টিস্যু যা দুই হাড়ের সংযোগস্থলে ঘর্ষণ কমিয়ে দেয় এবং মসৃণ চলাচলে সহায়তা করে। যখন এই কার্টিলেজ ক্ষয় হতে থাকে, তখন হাড়ের মধ্যে সরাসরি ঘর্ষণ হয়, যার ফলে ব্যথা, ফোলা এবং চলাচলে সীমাবদ্ধতা দেখা দেয়।
হাত বা কব্জির ক্ষেত্রে অস্টিওআর্থ্রাইটিস সাধারণত বুড়ো আঙুলের গোড়ার জয়েন্ট (CMC joint), মধ্যমা বা অন্য আঙুলের DIP (Distal Interphalangeal) জয়েন্টে বেশি দেখা যায়। মধ্যবয়সী থেকে শুরু করে বয়স্কদের মধ্যে এই সমস্যা বেশি পরিলক্ষিত হয়, বিশেষ করে যাঁরা দীর্ঘ সময় ধরে হাতের সূক্ষ্ম কাজ করেন।
অস্টিওআর্থ্রাইটিসের প্রধান কারণ:
বয়স:এটি সবচেয়ে বড় রিস্ক ফ্যাক্টর। ৪৫ বছর পর থেকে জয়েন্টের কার্টিলেজ ক্ষয় হতে শুরু করে।
বারবার একই কাজ করা:দীর্ঘদিন ধরে সেলাই, টাইপিং, লেখালেখি, কৃষিকাজ বা কাঠের কাজের মতো কাজগুলো হাতের জয়েন্টে চাপ সৃষ্টি করে।
পূর্ববর্তী আঘাত:অতীতে কোনো জয়েন্টে গুরুতর আঘাত পেলে সেই জয়েন্টে ভবিষ্যতে অস্টিওআর্থ্রাইটিসের ঝুঁকি বাড়ে।
হরমোনজনিত পরিবর্তন:বিশেষ করে নারীদের মেনোপজ-পরবর্তী সময়ে হরমোনের ভারসাম্য হারালে কার্টিলেজ ক্ষয়ের হার বেড়ে যায়।
অস্টিওআর্থ্রাইটিসের লক্ষণসমূহ
হাতে বা কব্জিতে অস্টিওআর্থ্রাইটিস হলে বেশ কিছু নির্দিষ্ট উপসর্গ দেখা যায়, যেগুলোর মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করা সহজ হয়।
আঙুলের জয়েন্টে ব্যথা:বিশেষ করে কাজের শেষে বা দীর্ঘক্ষণ ব্যবহারের পর জয়েন্টে ব্যথা অনুভূত হয়।
স্টিফনেস বা শক্তভাব:সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে আঙুল শক্ত থাকে এবং কিছুক্ষণ পর স্বাভাবিক হয়। এটিকে "মর্নিং স্টিফনেস" বলা হয়।
নড়াচড়ায় কষ্ট:জয়েন্টে মসৃণতা হারানোর ফলে আঙুল বাঁকানো বা সোজা করায় অসুবিধা হয়।
ফোলা ও হালকা গাঁট তৈরি হওয়া:DIP বা PIP জয়েন্টে ছোট ছোট হাড়ের গাঁট দেখা যায়, যাকে হেবার্ডেন বা বুশার্ডস নোড বলা হয়।
খটখট আওয়াজ (Crepitus):আঙুল ভাঁজ বা সোজা করার সময় জয়েন্টে ঘর্ষণের আওয়াজ হতে পারে।
অস্টিওআর্থ্রাইটিসের চিকিৎসা
অস্টিওআর্থ্রাইটিসের চিকিৎসা মূলত উপসর্গ নিয়ন্ত্রণ এবং জয়েন্টের কার্যক্ষমতা ধরে রাখার ওপর নির্ভরশীল। যেহেতু এটি সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য নয়, তাই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রোগীকে স্বস্তি দেওয়াই মূল উদ্দেশ্য।
১. জয়েন্টকে বিশ্রাম দিন:
অতিরিক্ত হাত ব্যবহার বা ভারী কাজ থেকে বিরত থাকুন।
মাঝেমধ্যে বিরতি নিয়ে হাতের ওপর চাপ কমান।
২. ওষুধ সেবন (NSAIDs):
নন-স্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি ড্রাগস (যেমন ইবুপ্রোফেন, ন্যাপ্রোক্সেন) ব্যথা ও ফোলা কমাতে সাহায্য করে।
ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত বা প্রয়োজনে সেবন করুন।
৩. ফিজিওথেরাপি ও নির্দিষ্ট ব্যায়াম:
হালকা স্ট্রেচিং ও strengthening ব্যায়াম করে পেশির শক্তি বজায় রাখা যায় এবং জয়েন্টের স্থায়িত্ব বাড়ে।
বল চেপে ধরা, কব্জি ঘোরানো, আঙুল ছড়িয়ে আবার ভাঁজ করা—এসব সহজ ব্যায়াম দৈনিক করা উপকারী।
গরম পানিতে হাত ডুবিয়ে রাখা ব্যথা ও স্টিফনেস কমাতে সাহায্য করে।
৪. স্প্লিন্ট বা ব্রেস ব্যবহার:
বুড়ো আঙুল বা কব্জির জয়েন্টে নির্দিষ্ট ধরনের স্প্লিন্ট ব্যবহার করলে জয়েন্টকে স্থির রাখা যায় এবং ব্যথা হ্রাস পায়।
রাতে বা নির্দিষ্ট কাজের সময় এটি ব্যবহার করলে উপকার পাওয়া যায়।
৫. লাইফস্টাইল ম্যানেজমেন্ট:
ওজন নিয়ন্ত্রণ করুন, কারণ অতিরিক্ত ওজন হাড়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।
স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ করুন, যাতে পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম, ভিটামিন D এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে।
ধূমপান ও অ্যালকোহল বর্জন করুন, যা হাড় ও জয়েন্টের স্বাস্থ্যকে খারাপ করতে পারে।
৬. অ্যাডভান্স চিকিৎসা (যদি প্রয়োজন হয়):
স্টেরয়েড ইনজেকশন: ফোলা ও ব্যথা তীব্র হলে জয়েন্টে স্টেরয়েড ইনজেকশন দেওয়া যেতে পারে।
Hyaluronic acid injection বা PRP (Platelet-Rich Plasma) থেরাপি কিছু ক্ষেত্রে উপকারি হতে পারে।
অপারেশন (Joint replacement surgery): খুবই বিরল ও শেষ ধাপে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়, যদি অন্যান্য সব চিকিৎসায় কাজ না করে।
৪। রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস (Rheumatoid Arthritis)

রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস (RA) হলো একটি দীর্ঘস্থায়ী, অটোইমিউন প্রকৃতির জয়েন্টের রোগ, যেখানে শরীরের ইমিউন সিস্টেম ভুল করে নিজেরই সুস্থ জয়েন্ট টিস্যুর বিরুদ্ধে আক্রমণ করে। এর ফলে জয়েন্টে প্রদাহ (inflammation) হয়, যা ধীরে ধীরে কার্টিলেজ ও হাড় ক্ষয় করে দেয় এবং জয়েন্ট বিকৃতির দিকে নিয়ে যায়। এই রোগটি প্রাথমিকভাবে হাত ও কব্জির ছোট জয়েন্টগুলিকে আক্রমণ করে, তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শরীরের অন্যান্য জয়েন্ট এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গও এতে জড়িত হতে পারে।
রোগটি প্রধানত ৩০–৫০ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়, যদিও পুরুষদেরও এটি হতে পারে। এটি জেনেটিক বা পারিবারিক ইতিহাসসম্পন্ন রোগ, অর্থাৎ পরিবারের অন্য কারো থাকলে আপনার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস কেন হয়?
RA-এর সঠিক কারণ এখনো সম্পূর্ণরূপে জানা যায়নি, তবে বিশেষজ্ঞদের মতে এর পেছনে একাধিক কারণ ভূমিকা রাখে:
জেনেটিক প্রভাব:পরিবারে যদি রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস থাকে, তবে আপনার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
অটোইমিউন প্রতিক্রিয়া:শরীরের ইমিউন সিস্টেম কোনো বাইরের সংক্রমণের পরিবর্তে নিজেই জয়েন্ট টিস্যুকে 'বিপদ' ভেবে আক্রমণ করে।
হরমোন:মহিলাদের মধ্যে RA বেশি দেখা যায়, যার পেছনে হরমোনের ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করা হয়।
পরিবেশগত কারণ:ধূমপান, সংক্রমণ বা দূষণের সংস্পর্শে এলার্জিজনিত প্রতিক্রিয়া থেকেও RA শুরু হতে পারে।
রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসের লক্ষণসমূহ
রোগটি ধীরে ধীরে শুরু হলেও কিছু স্পষ্ট লক্ষণ রয়েছে যা শুরুতেই চিকিৎসকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে:
সকালের কঠিনতা (Morning stiffness):সকালে ঘুম থেকে উঠে আঙুল নাড়াতে বা হাত ব্যবহার করতে কষ্ট হয়। এই স্টিফনেস ৩০ মিনিট থেকে কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
জয়েন্টে ব্যথা ও ফোলা:বিশেষ করে হাতের আঙুল, কব্জি এবং পায়ের ছোট জয়েন্টগুলো আক্রান্ত হয়। একই সঙ্গে দুটি হাতেই এই উপসর্গ দেখা যায় (Symmetrical arthritis)।
উষ্ণতা ও লালচেভাব:আক্রান্ত জয়েন্টগুলোতে হালকা তাপ অনুভব হয় এবং ত্বক কিছুটা লাল দেখায়।
জয়েন্ট বিকৃতি:দীর্ঘমেয়াদে জয়েন্টের গঠন পরিবর্তন হয়ে যায়; আঙুল বেঁকে যেতে পারে, কব্জি বাঁকা হয়ে যায়—হাতের কার্যক্ষমতা ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়।
সাধারণ দুর্বলতা ও ওজন হ্রাস:রোগীর ক্লান্তি, ক্ষুধামন্দা এবং শরীরের ওজন কমে যাওয়া দেখা যায়।
রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসা
RA একটি "নিয়ন্ত্রিত করা যায়, কিন্তু পুরোপুরি নিরাময়যোগ্য নয়" এমন রোগ। তাই চিকিৎসার মূল লক্ষ্য হলো ব্যথা ও প্রদাহ কমানো, জয়েন্টের ক্ষয় রোধ করা এবং দৈনন্দিন জীবনযাত্রা স্বাভাবিক রাখা।
১। দ্রুত রোগ নির্ণয়:
রোগ যত দ্রুত ধরা পড়বে, তত দ্রুত চিকিৎসা শুরু হলে জয়েন্টের ক্ষয় রোধ করা সম্ভব। প্রাথমিকভাবে নিম্নলিখিত পরীক্ষা করা হয়:
রক্ত পরীক্ষা:
Rheumatoid Factor (RF)
Anti-CCP (Cyclic Citrullinated Peptide)
ESR ও CRP – প্রদাহের মাত্রা বোঝার জন্য
ইমেজিং:এক্স-রে, আল্ট্রাসাউন্ড বা এমআরআই-এর মাধ্যমে জয়েন্টের অভ্যন্তরীণ ক্ষয় ও প্রদাহ নির্ণয় করা যায়।
২। DMARDs (Disease Modifying Anti-Rheumatic Drugs):
এই ওষুধগুলো RA-এর মূল চিকিৎসা। এগুলো রোগের অগ্রগতি ধীর করে এবং জয়েন্ট ধ্বংস রোধ করে।
Methotrexate
Sulfasalazine
Leflunomide
Hydroxychloroquine
বিশেষ সতর্কতা:DMARDs ওষুধগুলো দীর্ঘমেয়াদে ব্যবহার করতে হয় এবং নিয়মিত রক্তপরীক্ষা করে লিভার, কিডনি ও রক্তের মান পর্যবেক্ষণ করতে হয়। চিকিৎসকের নির্দেশ ছাড়া কখনো এই ওষুধ শুরু বা বন্ধ করবেন না।
৩। বায়োলজিক থেরাপি (Biologic Therapy):
যেসব রোগীর DMARDs-এ ভালো সাড়া পাওয়া যায় না, তাদের জন্য ইমিউন সিস্টেমকে আরও সূক্ষ্মভাবে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বায়োলজিক ওষুধ দেওয়া হয়। এগুলো অত্যাধুনিক ও ব্যয়বহুল হলেও কার্যকর।
TNF inhibitors
IL-6 inhibitors
JAK inhibitors
৪। ব্যথা ও প্রদাহ নিয়ন্ত্রণ:
NSAIDs (ইবুপ্রোফেন, ন্যাপ্রোক্সেন): ব্যথা ও ফোলা কমাতে ব্যবহৃত হয়।
স্টেরয়েড: তীব্র প্রদাহের সময়ে অল্প সময়ের জন্য ব্যবহার করা হয়।
৫। ফিজিওথেরাপি ও ব্যায়াম:
হাত ও আঙুলের গঠন ঠিক রাখতে এবং চলাচল বজায় রাখতে হালকা স্ট্রেচিং ও strengthening ব্যায়াম করা জরুরি।
হট বা কোল্ড থেরাপি উপশম দেয়।
অভিজ্ঞ ফিজিওথেরাপিস্টের নির্দেশনা অনুযায়ী নির্দিষ্ট ব্যায়াম করতে হবে।
৬। স্প্লিন্ট ব্যবহার:
ব্যথাযুক্ত বা ফোলা জয়েন্ট স্থির রাখতে বিশেষ স্প্লিন্ট ব্যবহার করা হয়।
এটি ব্যথা কমায়, কার্যক্ষমতা বজায় রাখে এবং বিকৃতি প্রতিরোধ করে।
৭। জীবনধারা ও খাদ্যাভ্যাস:
ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা
অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি খাবার (যেমন ওমেগা-৩, হলুদ, আদা, সবুজ শাকসবজি) খাওয়া
ধূমপান বন্ধ করা (RA ওষুধের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়)
মানসিক চাপ কমানো
৫। গাউট (Gout)

গাউট হলো এক ধরনের অস্থিসন্ধি প্রদাহ (arthritis), যা রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে জয়েন্টে ক্ৰিস্টাল জমে তৈরি হয়। এই ক্ৰিস্টালগুলো সাধারণত সোডিয়াম ইউরেট ক্ৰিস্টালের আকারে জয়েন্টে জমা হয়ে তীব্র প্রদাহ সৃষ্টি করে। গাউট সাধারণত পায়ের বুড়ো আঙুলের জয়েন্টে বেশি দেখা যায়, তবে এটি হাত, কব্জি, আঙুল এবং শরীরের অন্যান্য জয়েন্টেও দেখা দিতে পারে। পুরুষদের মধ্যে গাউট বেশি হলেও, মেনোপজ-পরবর্তী নারীদের মধ্যেও এই রোগ দেখা দিতে পারে।
এই রোগটি আচমকা এবং খুব দ্রুত শুরু হয়, অনেক সময় মাঝরাতে ঘুম ভেঙে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভবের মাধ্যমে লক্ষণ দেখা দেয়। এটি একবারে এক বা একাধিক জয়েন্টকে আক্রান্ত করতে পারে এবং সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে ধীরে ধীরে জয়েন্ট ক্ষয় ও স্থায়ী প্রতিবন্ধকতার দিকে নিয়ে যেতে পারে।
গাউট কেন হয়?
গাউটের মূল কারণ হলো হাইপারইউরিসেমিয়া—অর্থাৎ রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হওয়া। কিছু কারণে এই মাত্রা বেড়ে যেতে পারে:
খাদ্যাভ্যাস: অতিরিক্ত প্রোটিন, রেড মিট, সামুদ্রিক মাছ (সারডিন, অ্যাঙ্কোভি), মাশরুম, বাঁধাকপি, মটরশুঁটি, অ্যালকোহল (বিশেষত বিয়ার), ফ্রুকটোজযুক্ত পানীয় বেশি খেলে ইউরিক অ্যাসিড বেড়ে যেতে পারে।
জেনেটিক কারণ: পরিবারে গাউটের ইতিহাস থাকলে আপনার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
অতিরিক্ত ওজন ও স্থূলতা
ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ, হাইপারটেনশন
কিছু ওষুধের প্রভাব: যেমন—ডাইইউরেটিকস, অ্যাসপিরিন
গাউটের লক্ষণসমূহ
গাউট সাধারণত আচমকা শুরু হয় এবং খুব দ্রুত জয়েন্টে তীব্র ব্যথা ও প্রদাহ তৈরি করে। লক্ষণগুলো হল:
জয়েন্টে হঠাৎ করে তীব্র ব্যথা:বিশেষ করে হাতে বা কব্জির জয়েন্ট ফুলে যায়, স্পর্শ করলে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। অনেক সময় ব্যথা এতটাই তীব্র হয় যে হালকা চাদর বা কাপড়ের স্পর্শেও যন্ত্রণা হয়।
ফোলা ও লালচে ভাব:আক্রান্ত জয়েন্ট ফুলে যায়, ত্বকে লালচে বা বেগুনি আভা দেখা যায়, এবং স্থানটি উষ্ণ অনুভূত হয়।
রাতে ব্যথা বেড়ে যাওয়া:গাউটের ব্যথা প্রায়শই রাতের বেলায় হঠাৎ বেড়ে যায় এবং ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়।
আক্রমণের মধ্যবর্তী সময়ে কোনো লক্ষণ না থাকা:গাউটের প্রথম আক্রমণের পর ব্যথা সেরে গেলে অনেক সময় দীর্ঘ সময় কোনো উপসর্গ থাকে না। তবে পরবর্তী আক্রমণ আরও তীব্র হতে পারে।
Tophi (দীর্ঘস্থায়ী গাউটে):দীর্ঘদিন ইউরিক অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণে না থাকলে ত্বকের নিচে ছোট ছোট কঠিন গাঁট (Tophi) তৈরি হয়, যা জয়েন্টের গঠন নষ্ট করে দিতে পারে।
গাউটের চিকিৎসা
গাউটের চিকিৎসা দুইটি ভাগে বিভক্ত:১) আক্রমণের সময় ব্যথা ও প্রদাহ কমানো২) দীর্ঘমেয়াদে ইউরিক অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণে রাখা
১। গাউট আক্রমণের সময় কী করবেন?
ব্যথা ও ফোলার জন্য বরফ প্রয়োগ:আক্রান্ত জয়েন্টে দিনে কয়েকবার ১৫-২০ মিনিট বরফ লাগাতে পারেন। এটি প্রদাহ ও ফোলা কমাতে সাহায্য করে।
পুরোপুরি বিশ্রাম:ব্যথাযুক্ত জয়েন্টকে সম্পূর্ণ বিশ্রাম দিন। কোনো ভার বহন বা নাড়াচাড়া করবেন না।
ব্যথানাশক ওষুধ:NSAIDs যেমন ইবুপ্রোফেন, ন্যাপ্রোক্সেন ইত্যাদি ব্যথা ও প্রদাহ কমাতে ব্যবহৃত হয়।চিকিৎসকের পরামর্শে Colchicine বা স্টেরয়েড দেওয়া যেতে পারে যদি NSAID স্যুট না করে।
২। ইউরিক অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণে রাখা
গাউটের পুনরাবৃত্তি রোধ করতে হলে রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা নিয়মিতভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা আবশ্যক। এর জন্য:
ডায়েট ম্যানেজমেন্ট:
কম পুরিনযুক্ত খাবার গ্রহণ করুন
রেড মিট, শেলফিশ, অ্যালকোহল, মিষ্টি পানীয় এড়িয়ে চলুন
প্রচুর পানি পান করুন (কমপক্ষে ২–৩ লিটার/দিন)
ওষুধ সেবন (চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী):
Allopurinol বা Febuxostat: ইউরিক অ্যাসিড উৎপাদন কমায়
Probenecid: ইউরিক অ্যাসিড মূত্রের মাধ্যমে বের করে দিতে সাহায্য করে
নিয়মিত রক্তপরীক্ষার মাধ্যমে ইউরিক অ্যাসিড লেভেল মনিটর করা জরুরি
কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন?
প্রথমবার গাউটের উপসর্গ দেখা দিলে
ব্যথা ও ফোলা ২-৩ দিনের মধ্যে না কমলে
একাধিক জয়েন্ট আক্রান্ত হলে
ঘন ঘন গাউটের আক্রমণ হলে
ত্বকের নিচে গাঁট দেখা দিলে (Tophi)
৬। সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিস (Psoriatic Arthritis)

সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিস (PsA) হলো এক ধরনের দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহজনিত জয়েন্টের রোগ, যা সাধারণত সোরিয়াসিস নামক ত্বকের রোগের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এটি একটি অটোইমিউন ডিজঅর্ডার, অর্থাৎ শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিজের সুস্থ কোষ ও টিস্যুকে আক্রমণ করে। এই রোগটি শুধু ত্বকে প্রভাব ফেলে না, বরং হাড়, জয়েন্ট, টেন্ডন এবং এমনকি নখেও পরিবর্তন ঘটাতে পারে।
প্রায় ৩০% সোরিয়াসিস আক্রান্ত রোগীর মধ্যে পরবর্তীতে সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিস দেখা দিতে পারে। এই রোগটি পুরুষ ও মহিলা উভয়ের মধ্যেই সমানভাবে দেখা যায় এবং সাধারণত ৩০–৫০ বছর বয়সে শুরু হয়।
সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিস কেন হয়?
অটোইমিউন প্রতিক্রিয়া:শরীরের ইমিউন সিস্টেম ভুলবশত জয়েন্টের স্বাস্থ্যবান কোষকে ‘বিপদ’ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং তা ধ্বংস করতে চেষ্টা করে।
জেনেটিক প্রভাব:পরিবারের কারো যদি সোরিয়াসিস বা সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিস থাকে, তবে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
পরিবেশগত কারণ:সংক্রমণ, তীব্র মানসিক চাপ, আঘাত বা ত্বকে আঘাত লাগলে রোগ সক্রিয় হতে পারে।
ইনফেকশন:কিছু ভাইরাল বা ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ রোগটিকে সক্রিয় করতে পারে।
সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিসের লক্ষণ
এই রোগের উপসর্গগুলো ধীরে ধীরে শুরু হতে পারে আবার হঠাৎ করেও দেখা দিতে পারে। অনেক সময় ত্বকের উপসর্গের আগেই জয়েন্টের প্রদাহ শুরু হয়।
হাতের জয়েন্টে ব্যথা ও ফোলা:বিশেষত কব্জি, আঙুল ও হাতের ছোট জয়েন্টে ব্যথা ও ফোলাভাব দেখা যায়। ব্যথা একদিকে বা উভয় হাতেই হতে পারে।
Dactylitis (সসেজের মতো আঙুল):আঙুল ফুলে গিয়ে দেখতে অনেকটা সসেজের মতো লাগে। এটি সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিসের একটি বিশেষ লক্ষণ।
নখের পরিবর্তন:নখে গর্ত বা দাগ পড়া, নখের রং পরিবর্তন, নখ আলগা হয়ে যাওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যেতে পারে।
জয়েন্ট স্টিফনেস বা শক্ত হয়ে যাওয়া:সকালে ঘুম থেকে উঠে হাত শক্ত লাগা বা নাড়াতে কষ্ট হওয়া—বিশেষ করে এটি দীর্ঘক্ষণ বিশ্রামের পর বেশি হয়।
জয়েন্ট বিকৃতি:দীর্ঘদিন রোগ চলতে থাকলে আঙুলের গঠন বিকৃত হতে পারে, কব্জির কার্যক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে।
পিঠ ও ঘাড়ে ব্যথা:কিছু রোগীর ক্ষেত্রে মেরুদণ্ড এবং স্যাক্রোইলিয়াক জয়েন্টও আক্রান্ত হতে পারে, যার ফলে কোমরে ও ঘাড়ে ব্যথা হয়।
সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসা
Psoriatic Arthritis একটি জটিল রোগ এবং এর চিকিৎসায় প্রয়োজন একাধিক বিশেষজ্ঞের সমন্বিত উদ্যোগ। চিকিৎসার মূল লক্ষ্য হলো —✔ জয়েন্টের ব্যথা ও প্রদাহ নিয়ন্ত্রণ✔ জয়েন্ট বিকৃতি প্রতিরোধ✔ ত্বকের সমস্যা নিয়ন্ত্রণ✔ জীবনমান উন্নয়ন
১। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সমন্বিত চিকিৎসা:
ডার্মাটোলজিস্ট (ত্বকের চিকিৎসক) – সোরিয়াসিসের চিকিৎসা দেন
রিউম্যাটোলজিস্ট (জয়েন্ট বিশেষজ্ঞ) – আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসা করেন
এই দুই বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে চিকিৎসা হলে রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হয়।
২। ওষুধ:
NSAIDs (ইবুপ্রোফেন, ন্যাপ্রোক্সেন): ব্যথা ও প্রদাহ কমাতে ব্যবহৃত হয়
DMARDs (Disease-Modifying Anti-Rheumatic Drugs):
Methotrexate
Sulfasalazine
Leflunomideএগুলো রোগের অগ্রগতি ধীর করে এবং জয়েন্ট ক্ষয় প্রতিরোধ করে
বায়োলজিক থেরাপি:
TNF-α ইনহিবিটর (Adalimumab, Etanercept)
IL-17 ও IL-12/23 ইনহিবিটরএগুলো তীব্র সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিসে অত্যন্ত কার্যকর
নখের সমস্যার জন্য টপিকাল থেরাপি বা পিলস ব্যবহার করা হয়
বি.দ্র: এসব ওষুধ শুরু ও চালিয়ে যেতে হলে নিয়মিত রক্তপরীক্ষা ও চিকিৎসকের নজরদারি আবশ্যক।
৩। ফিজিওথেরাপি ও ব্যায়াম:
হালকা স্ট্রেচিং ও strengthening এক্সারসাইজ জয়েন্ট নমনীয় রাখতে সাহায্য করে
ফিজিওথেরাপি পেশিশক্তি বাড়াতে ও ব্যথা কমাতে সাহায্য করে
দীর্ঘ সময় এক জায়গায় বসে থাকা বা এক কাজ করা এড়িয়ে চলুন
৪। জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাস:
ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন (স্থূলতা জয়েন্টের ওপর বাড়তি চাপ ফেলে)
এলার্জি বা প্রদাহ বাড়ায় এমন খাবার এড়িয়ে চলুন
অ্যালকোহল, ধূমপান থেকে বিরত থাকুন
মানসিক চাপ কমানোর জন্য মেডিটেশন বা যোগব্যায়াম করতে পারেন
৭। ইনফেকটিভ আর্থ্রাইটিস (Infective Arthritis)

ইনফেকটিভ আর্থ্রাইটিস, যাকে সেপ্টিক আর্থ্রাইটিস-ও বলা হয়, এটি একটি জয়েন্ট সংক্রমণজনিত জরুরি অবস্থা, যেখানে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা ছত্রাকের সংক্রমণের ফলে জয়েন্টে প্রদাহ তৈরি হয় এবং প্রয়োজনে পুঁজ জমে যেতে পারে। এটি শরীরের যেকোনো জয়েন্টে হতে পারে, তবে হাত, কব্জি, হাঁটু, কাঁধ—এই জয়েন্টগুলোতে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।
এই রোগটি অন্যান্য আর্থ্রাইটিসের মতো নয়—এটি অত্যন্ত দ্রুত গতিতে জয়েন্ট ধ্বংস করতে পারে এবং উপেক্ষা করলে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে জীবনহানির ঝুঁকিও তৈরি হতে পারে। তাই রোগটির তাৎক্ষণিক শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা শুরু করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ইনফেকটিভ আর্থ্রাইটিস কেন হয়?
জয়েন্টে জীবাণু পৌঁছানোর বিভিন্ন পথ থাকতে পারে:
রক্তের মাধ্যমে সংক্রমণ:শরীরের অন্য কোথাও (যেমন দাঁতের সংক্রমণ, কিডনির ইনফেকশন, ত্বকে ফোঁড়া) থেকে জীবাণু রক্তের মাধ্যমে জয়েন্টে ছড়াতে পারে।
আঘাত বা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে:কাটা-ছেঁড়া বা ইনজেকশন, অপারেশনের মাধ্যমে জীবাণু সরাসরি জয়েন্টে প্রবেশ করতে পারে।
ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হলে:ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, এইডস, কিডনি রোগ বা ইমিউনসাপ্রেসিভ ওষুধ গ্রহণের ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে এই ঝুঁকি বেড়ে যায়।
লক্ষণসমূহ
ইনফেকটিভ আর্থ্রাইটিসের উপসর্গগুলো দ্রুত ও তীব্র হয়। রোগ শুরু হওয়ার পর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই জয়েন্টের অবস্থা খারাপ হতে পারে।
হঠাৎ তীব্র ব্যথা ও ফোলা:আক্রান্ত হাত বা কব্জির জয়েন্টে হঠাৎ তীব্র ব্যথা শুরু হয়, সঙ্গে সঙ্গে জয়েন্ট ফুলে যায় এবং নাড়াচাড়া করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
লালচে ও উষ্ণ অনুভূত স্থান:জয়েন্টের চামড়া লাল হয়ে যায় এবং স্পর্শ করলে স্থানটি গরম লাগে।
উচ্চমাত্রার জ্বর:সংক্রমণের কারণে শরীরে ১০১–১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত জ্বর দেখা দিতে পারে, সঙ্গে থাকতে পারে কাঁপুনি ও ঘাম।
সম্পূর্ণ অক্ষমতা:ব্যথা এতটাই তীব্র হয় যে আক্রান্ত জয়েন্ট নাড়ানো সম্ভব হয় না; দৈনন্দিন কাজকর্ম সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
পুঁজ জমা হওয়া (Advanced cases):জয়েন্টে সাইনোভিয়াল তরলের বদলে পুঁজ জমে যায়, যা স্থানীয় সংক্রমণ ছাড়াও রক্তে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
কীভাবে রোগ নির্ণয় হয়?
রক্ত পরীক্ষা:
ESR, CRP – প্রদাহের মাত্রা পরিমাপ
CBC – সাদা রক্তকণিকার (WBC) সংখ্যা বৃদ্ধি
রক্ত কালচার – জীবাণু সনাক্তকরণ
জয়েন্ট অ্যাসপিরেশন (Synovial fluid analysis):জয়েন্ট থেকে তরল বের করে জীবাণু শনাক্ত করা হয় এবং পুঁজের উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয়।
ইমেজিং (X-ray/Ultrasound/MRI):হাড়ের অবস্থা, তরলের পরিমাণ ও সংক্রমণের পরিধি জানার জন্য করা হয়।
চিকিৎসা
ইনফেকটিভ আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসা যত দ্রুত শুরু হবে, তত ভালো ফল পাওয়া যায়। বিলম্ব হলে জয়েন্ট সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হতে পারে।
১। দ্রুত অ্যান্টিবায়োটিক থেরাপি:
জীবাণুর ধরন অনুসারে শক্তিশালী ইন্ট্রাভেনাস অ্যান্টিবায়োটিক (IV antibiotics) শুরু করতে হয়।
কখনো কখনো সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়ার আগেই broad-spectrum অ্যান্টিবায়োটিক শুরু করা হয়।
২। জয়েন্ট পরিষ্কার করা (Joint drainage):
যদি জয়েন্টে পুঁজ জমে যায়, তাহলে সেটা বের করে দিতে হয়।
এটি সিরিঞ্জ দিয়ে অ্যাসপিরেশন, আর্থ্রোস্কোপি, অথবা প্রয়োজনে খুলে অস্ত্রোপচার (open surgical drainage) মাধ্যমেও করা হতে পারে।
৩। হাসপাতালে ভর্তি ও পর্যবেক্ষণ:
প্রাথমিক অবস্থায় রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা শুরু করতে হয়।
প্রয়োজনে ফিজিওথেরাপি যোগ করে জয়েন্টের কার্যক্ষমতা বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়।
ঝুঁকি এড়াতে যা করবেন:
ছোটখাটো ইনফেকশন অবহেলা করবেন না—তা থেকেও জয়েন্টে সংক্রমণ ছড়াতে পারে
দাঁতের সমস্যা, ফোঁড়া, সাইনাস ইনফেকশন ইত্যাদি দ্রুত চিকিৎসা করান
ইমিউনসাপ্রেসিভ ওষুধ (যেমন ক্যান্সার, অঙ্গপ্রতিস্থাপন রোগীদের) নিলে সুরক্ষাব্যবস্থা নিন
ডায়াবেটিস ও অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখুন
৮। অন্যান্য কারণ:
হাত ও কব্জির ব্যথা অনেক সময় সাধারণ কারণের বাইরে আরও কিছু বিশেষ ও অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত রোগ থেকেও হতে পারে, যেগুলো যথাসময়ে চিহ্নিত না হলে দীর্ঘমেয়াদি অস্বস্তি ও জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম হলো গ্যাংলিয়ন সিস্ট, যা তরলভর্তি একধরনের গাঁট এবং সাধারণত কব্জির পিছনের দিকে বা আঙুলের গোড়ার কাছে দেখা যায়। এটি সাইনোভিয়াল তরলে পূর্ণ একটি সিস্ট, যা সাধারণত ব্যথাহীন হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে চাপ বা মুভমেন্টে ব্যথা হতে পারে। চিকিৎসার মধ্যে সিস্ট খালি করা বা অস্ত্রোপচার অন্তর্ভুক্ত। ট্রিগার ফিঙ্গার হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে আঙুল বাঁকানো অবস্থায় আটকে যায় এবং সোজা করতে গেলে একধরনের ‘লক’ অনুভব হয়, অনেকটা ট্রিগার টানার মতো। এটি সাধারণত টেন্ডনের শীথ মোটা হয়ে যাওয়ার কারণে হয় এবং চিকিৎসায় স্টেরয়েড ইনজেকশন, স্প্লিন্ট ও প্রয়োজনে অপারেশন করা হয়। ডি-কুয়েরভ্যান ডিজিজ একটি টেনোসাইনোভাইটিসজনিত সমস্যা, যেখানে কব্জির পাশে অবস্থিত টেন্ডনে প্রদাহ তৈরি হয় এবং এতে আঙুল বা কব্জি নাড়ালে ব্যথা হয়। এটি সাধারণত নবজাতকের মা, গৃহিণী, মোবাইল ব্যবহারকারী বা যারা একভাবে হাত ব্যবহার করেন তাদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। চিকিৎসায় বিশ্রাম, ব্যথানাশক, স্টেরয়েড ইনজেকশন বা প্রয়োজনে সার্জারি অন্তর্ভুক্ত। আরেকটি জটিল অবস্থা হলো ডুপুইট্রেন কন্ট্র্যাকচার, যেখানে হাতের তালুর নিচের ফ্যাসিয়া টিস্যু মোটা হয়ে যায় এবং এক বা একাধিক আঙুল ধীরে ধীরে বাঁকা হয়ে যায়। এতে আক্রান্ত আঙুল পুরোপুরি সোজা করা যায় না, এবং এটি প্রায়শই পুরুষদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। চিকিৎসায় ইনজেকশন, ফিজিওথেরাপি এবং সার্জারি অন্তর্ভুক্ত থাকে। সবচেয়ে জটিল এবং বিরল রোগগুলোর একটি হলো কিয়েনবক ডিজিজ, যা কব্জির একটি ছোট হাড় (lunate bone)–এর রক্তসঞ্চালন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হয়। এতে হাড় ধীরে ধীরে মারা যায় এবং কব্জিতে তীব্র ব্যথা, দুর্বলতা ও নড়াচড়ায় সমস্যা দেখা দেয়। এর চিকিৎসা নির্ভর করে রোগের স্তরের ওপর—প্রাথমিক অবস্থায় বিশ্রাম ও ব্যথানাশক, আর অগ্রসর পর্যায়ে অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হতে পারে। এইসব সমস্যাগুলো প্রথম দিকে তেমন গুরুতর মনে না হলেও সময়ের সাথে জটিলতা বাড়াতে পারে, তাই যেকোনো রকম অস্বাভাবিক ব্যথা, আঙুল লক হওয়া, জয়েন্টে ফোলা বা দুর্বলতা দেখা দিলে অবহেলা না করে দ্রুত একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করলেই হাত ও কব্জির স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা দীর্ঘদিন ধরে বজায় রাখা সম্ভব।
উপসংহার:
হাতে বা কব্জিতে ব্যথা কেন হয়—প্রশ্নটি যদি আপনাকে ভাবায়, তবে প্রথমেই ব্যথার কারণ চিহ্নিত করে যথাযথ চিকিৎসা শুরু করুন। উপেক্ষা বা বিলম্ব করলে সমস্যা স্থায়ী হতে পারে। তাই সামান্য ব্যথাকেও গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং সুস্থ, সক্রিয় জীবনযাপন করুন।
ডা. দেবজ্যোতি দত্ত - সমব্যথী পেইন ক্লিনিক
লেখক পরিচিতি: ডা. দেবজ্যোতি দত্ত

ডা. দেবজ্যোতি দত্ত কলকাতার একজন খ্যাতনামা ব্যথা বিশেষজ্ঞ, যিনি ইন্টারভেনশনাল পেইন ম্যানেজমেন্টে বিশেষ অভিজ্ঞ। তিনি কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস এবং কিং জর্জ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যানাস্থেসিয়োলজিতে এমডি সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে মায়ামি থেকে FIPP ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি সামোবাথি পেইন ক্লিনিক ও ফোর্টিস হাসপাতাল, কলকাতায় পেইন কনসালট্যান্ট হিসেবে কর্মরত। এশিয়ান পেইন একাডেমির ফ্যাকাল্টি, ISSP-এর রেজিস্ট্রার ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সদস্য হিসেবে তিনি দেশ-বিদেশে চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেন। ব্যথা ব্যবস্থাপনায় তার বিশেষ অবদানের জন্য তিনি বহু পুরস্কারে সম্মানিত।
Comments